Header Ads Widget

Responsive Advertisement

"বদ রক্ত"- রাহাত আহমেদ



ফরাসি দেশের প্রাচীন অধিবাসী গলদের থেকে আমি পেয়েছি আমার ফিকে নীল চোখ, একখানা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক, আর প্রতিযোগীতায় আনাড়িপনা । আমার মনে হয় আমার জামাকাপড় তাদের মতনই অমার্জিত ।

কিন্তু আমি চুলে তেল লাগাই না ।

সেই প্রাচীন অধিবাসী গলরা ছিল তাদের সময়ের অত্যন্ত মূর্খ  চামার আর খড় পোড়ানোর দল। তাদের কাছ থেকে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি : প্রতিমা-উপাসনা, আর যা-কিছু পবিত্র তাকে নোংরা করে দেবার প্রতি টান ; ওহ ! যতোরকমের কদভ্যাস হতে পারে, ক্রোধ, লাম্পট্য, -- ভয়ানক ব্যাপার, এই লাম্পট্য ; -- তাছাড়া মিথ্যে কথা বলা, আর সবার ওপরে আলস্য ।

যাবতীয় ব্যবসাপাতি আর কাজকারবার সম্পর্কে আমি বেশ আত্ঙ্কে ভুগি । কর্তাব্যক্তিদের আর খেটে-খাওয়া লোকেদের সম্পর্কে, ওরা সব্বাই চাষাড়ে আর মামুলি । যে হাত কলম ধরে থাকে তা লাঙল ধরে থাকা হাতের মতনই শুভ। -- হাতের ব্যাপারে একটা শতাব্দী বলা যায় ! -- আমি কোনোদিনও আমার হাত ব্যবহার করতে শিখবো না । আর হ্যাঁ, পারিবারিক ঝুঠঝামেলা তো আরও এক কাঠি বাড়া । ভিক্ষা চাওয়ার মালিকানা আমাকে লজ্জা দেয় । অপরাধীরা অণ্ডকোষহীন পুরুষদের মতোই নিদারুণ বিরক্তিকর : আমি আছি বহাল তবিয়তে, আর আমি কাউকে পরোয়া করি না ।

কিন্তু ! কে আমার জিভকে এতো বেশি মিথ্যা-সুদর্শনে ভরে তুলেছে, যা কিনা আমাকে এতোদিন পর্যন্ত পরামর্শ দিয়েছে আর অলস করে রেখেছে ? আমি তো আমার জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে শরীরকেও ব্যবহার করিনি । ঘুমন্ত কোলাব্যাঙের আলস্যকে ছাপিয়ে, আমি সব রকমের জায়গায় বসবাস করেছি ।এ শহরের এমন কোনো পরিবার নেই যাদের আমি চিনি না। -- পরিবার বলতে, আমি বোঝাতে চাইছি, যেমন আমার, যারা  মানুষের অধিকারের ফতোয়ার জোরে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে । -- আমি প্রতিটি পরিবারের সবচেয়ে বড়ো ছেলেকে চিনি! 

-------------------------------

যদি বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো একটা সময়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক থাকতো !

কিন্তু তার বদলে, কিছুই নেই ।

আমি ভালো করেই জানি যে আমি চিরটাকাল এক নিকৃষ্টতর জাতির মানুষ । আমি দ্রোহ ব্যাপারটা বুঝতে পারি না ।  নেকড়ের পালের মতন কোনো  জানোয়ারকে ছিঁড়ে খাবার জন্য, যা তারা নিজেরা মারেনি, আর লুঠপাচার বাদ দিলে, আমার জাতি কখনও উঠে দাঁড়ায়নি ।

একজন গ্রাম্য চাকর হিসাবে ; আমার মগজের ভেতরে ব্যাভেরিয়ার বনানীর ভেতর দিয়ে অজস্র পথ রয়েছে, বসফরাসের বাইজেনটিয়াম সাম্রাজ্যের ছবি, জেরুজালেমের কেল্লা ; মেরির পুজোপদ্ধতি, ক্রুশকাঠে ঝোলানো আল্লাহ সম্পর্কে দুঃখদায়ক চিন্তা, আমার মগজের ভেতরে হাজার অবজ্ঞায় পুলকিত হতে থাকে। -- রোদ্দুরের কামড়ে ধ্বসে পড়া দেয়ালের কিনারায়, ভাঙাচোরা মাটির বাসনকোসন আর বিছুটিবনের মাঝে আমি একজন কুষ্ঠরোগির মতন বসে থাকি । --- আর তাছাড়া, আমি একজন উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে ভাড়াটে সৈনিক,নরকের আগুনের সাথে সময় কাটাতাম ।

আহ ! আরেকটা ব্যাপার : বুড়ি আর বাচ্চাদের দলের সঙ্গে অত্যুজ্জ্বল লালচে ফাঁকা মাঠে আমি স্যাবাথছুটির নাচ নেচে চলেছি ।

আমি এই দেশ আর ইসলামধর্মের বিষয়ে বিশেষ কিছুই মনে রাখতে পারিনি । আমি নিজেকে চিরটাকাল অতীতে দেখতে পাবো । কিন্তু সবসময়ে একা ; পরিবারহীন ; প্রকৃতপক্ষে, কোন সেই ভাষা, যাতে আমি কথা বলতাম ? আমি কখনও নিজেকে ইসলামিক পারিষদবর্গের সদস্য হিসেবে দেখি না ; সন্তদের সভাতেও নয়, -- যারা ইসলামধর্ম প্রতিনিধি ।

এক যুক আগে আমি ঠিক কী ছিলাম : আজকে আমি কেবল নিজেকে খুঁজে পাই । টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো সেইসব লোকগুলো, ধূসর যুদ্ধগুলো উধাও হয়ে গেছে । নিকৃষ্ট জাতি চেপে বসেছে সবার ওপরে -- যাকে লোকে বলে  জনসাধারণ, যুক্তিপূর্ণতা ; রাষ্ট্র এবং বিজ্ঞান ।

আহ ! বিজ্ঞান ! সমস্তকিছু অতীত থেকে নিয়ে আসা হয় । শরীর আর আত্মার জন্যে, -- শেষ আধ্যাত্মিক সংস্কার, -- আমাদের রয়েছে ওষুধ আর দর্শনতত্ব, বাড়িতে সারিয়ে তোলার টোটকা আর নতুনভাবে বাঁধা লোকগান । এবং রাজকীয় আমোদপ্রমোদ, আর যে সমস্ত খেলাধুলা রাজারা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে ! ভূগোল, আকাশবিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যা, রসায়ন !...

বিজ্ঞান, নবতর আভিজাত্য ! প্রগতি । জগতসংসার এগিয়ে চলেছে !.... আর কেনই বা তা করবে না ?
আমাদের রয়েছে গণিতের দৃষ্টিপ্রতিভা । আমরা এগিয়ে চলেছি প্রাণচাঞ্চল্যের দিকে । আমি যা বলছি তা অমোঘ রহস্যপূর্ণ এবং ধ্রুবসত্য । আমি বুঝতে পারি, আর যেহেতু আমি পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট শব্দাবলী ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না, আমি বরং চুপ করে থাকবো ।

পৌত্তলিকতার নিকৃষ্ট রক্ত ফিরে বইতে থাকে শরীরে ! প্রাণচাঞ্চল্য এখন আয়ত্বে, আল্লাহ কেন আমাকে সাহায্য করেন না, কেন আমার আত্মাকে আভিজাত্য আর স্বাধীনতা দেন না । আহ !

আমি হাঘরের মতন ঈশ্বরের জন্যে অপেক্ষা করি । আমি চিরকালের জন্যে, চিরকালের জন্যে, এক নিকৃষ্ট জাতের মানুষ ।

আর এখন আমি নিকৃষ্ট শহর ঢাকার বুকে । শহরগুলো সন্ধ্যায় তাদের আলোকমালা জ্বালিয়ে দিক । আমার দিনকাল ফুরিয়ে গেছে ; আমি এ শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি এ শহরে মুখোশ আমার ফুসফুসকে গরম করে তুলবে ; হারিয়ে-যাওয়া আবহাওয়া আমার ত্বককে পালটে ফেলবে চামড়ায় । সাঁতার কাটার জন্যে, ঘাসভূমি মাড়িয়ে চলার জন্যে, শিকার করার জন্যে, সবচেয়ে প্রিয় ধোঁয়াফোঁকার জন্যে ; কড়া মদ খাবার জন্যে, সে মদ গলিয়ে ফেলা লোহার মতন কড়া, -- আগুনের চারপাশে  আমার প্রণম্য পূর্বপুরুষরা যেমন ভাবে বসে থাকতেন ।

আমি লোহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ফিরে আসবো, কালো ত্বক, আর রাগি দুটো চোখ : এই মুখোশে, ওরা সবাই মনে করবে আমি উৎকৃষ্ট জাতির মানুষ । আমার কাছে থাকবে স্বর্ণভাঁড়ার : আমি হয়ে উঠবো নৃশংস আর শ্রমবিমুখ । যে দুর্ধষ্য পঙ্গুরা গ্রীষ্মমণ্ডলের দেশ থেকে ফিরে আসে, তরুণীরা তাদের সেবা করে । আমি রাষ্ট্রনীতিতে জড়িয়ে পড়বো । বেঁচে যাবো ।

এখন আমি অভিশপ্ত, আমি আমার নিজের দেশকে অপছন্দ করি । সবচেয়ে ভালো হলো মাতাল অবস্হায় ঘুমোনো, চিলতেখানেক কোনো সমুদ্রতীরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া ।

--------------------------

কিন্তু কেউই ছেড়ে চলে যায় না । --- আরেকবার বেরিয়ে পড়া যাক আমাদের এলাকার পথে-পথে, আমার অধার্মিকতার ভার সঙ্গে নিয়ে, সেই অধার্মিকতা যা যুক্তিপূর্ণতার যুগ থেকে আমার অস্তিত্বে দুঃখকষ্টের শিকড় পুঁতে দিয়েছে -- স্বর্গ পর্যন্ত উঠে যাওয়া, আমাকে বিদ্ধস্ত করে, ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দ্যায়, আমাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যায় ।

চরম পাপহীনতা, শেষ মায়া । সবকিছু বলা হয়ে গেছে । পৃথিবীতে আমার জঘন্যতা ও বিশ্বাসঘাতকতা  আর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার নয় ।

চলে এসো ! কুচকাওয়াজ করে, ভার কাঁধে তুলে, মরুভূমি, একঘেয়েমির বিরক্তি এবং ক্রোধ নিয়ে।

কার কাছে গিয়ে ভাড়া করা মজুর হবো ? কোন সে জানোয়ারদের আদর করি ? কোন পবিত্র মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করি ? কেমনতর হৃদয়কে ভাঙি ? কোন মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিই ? -- কোন সে রক্তের নদী হেঁটে পার হই ? বরং বিচার থেকে দূরত্ব রাখা ভালো । -- এক কঠিন জীবন, সুস্পষ্ট বিস্ময়, -- কফিনের ঢাকা তোলার জন্যে একটা শুকনো মুঠো, শুয়ে থাকো, আর দম বন্ধ হয়ে যাক । এইভাবে বার্ধক্যে পৌঁছোবার কথা নয়, কোনো বিপদ নেই :

--আহ ! আমি এমন পরিত্যক্ত যে নিজেকে কোনও না কোনও স্মৃতিমন্দিরে গিয়ে নিখুঁত হবার আবেগ  উৎসর্গ করব ।

ওহ আমার আত্ম-অস্বীকৃতি, আমার মনোমুগ্ধকর বিশ্বপ্রেম ! আমার নিঃস্বার্থপর ভালোবাসা ! অথচ তবু আমি এই তলানিতে !

গভীর অতল থেকে কেঁদে উঠি, আমি আসলে একটা গাধা !

----------------------------------

যখন আমি এক ছোট্ট শিশু ছিলাম, আমি সেই দণ্ডিত অপরাধীকে শ্রদ্ধা করতাম যার মুখের ওপর কারাগারের দরোজা সদাসর্বদা বন্ধ থাকবে ; আমি সেই সমস্ত মদের আসর আর ভাড়াদেয়া ঘরগুলোয় যেতাম যেগুলোকে তার উপস্হিতি পবিত্রতায় উন্নীত করেছে ; আমি তার চোখ দিয়ে নীলাকাশ আর ফুলে ছাওয়া মাঠের কর্মোন্মাদনা দেখতাম ; শহরের রাস্তায় আমি তার সর্বনাশা সুগন্ধকে অনুসরণ করেছি । তার ছিল সন্তদের চেয়েও বেশি ক্ষমতা, যেকোনো অনুসন্ধানকারীর চেয়েও বেশি বোধশক্তি -- আর সে, কেবল সে-ই ! নিজের মহিমা  এবং নিজের ন্যায়পরায়ণতার সাক্ষী ছিল ।

শীতের রাতের ফাঁকা রাস্তা-বরাবর, ঘরছাড়া, ঠাণ্ডায় কাতর, আর ক্ষুধার্ত, একটা কন্ঠস্বর আমার হিমায়িত হৃদয়কে আঁকড়ে ধরল : “দুর্বলতা হোক বা শক্তিমত্তা : তুমি টিকে আছো, তাইই হলো শক্তিমত্তা । তুমি জানো না তুমি কোথায় চলেছো কিংবা কেন তুমি কোথাও যাচ্ছো, যেদিকে চাও যাও, সবাইকে জবাব দাও । কেউই তোমাকে মেরে ফেলবে না, তুমি শবদেহ হলে যেরকম করতো তার চেয়ে বেশি কিছু নয় ।” সকালবেলায় আমার চোখদুটো এতো বেশি ফ্যালফ্যালে হয়ে উঠেছিল আর মুখ শবের মতন ফ্যাকাশে, যে যাদের সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছিল তারা যেন আমায় দেখতে পাচ্ছিল না ।

শহরগুলোয়, কাদার রঙ আচমকা বদলে গিয়ে লাল আর কালো হয়ে উঠল, পাশের ঘরে আলোর শিখা কাঁপলে আয়নায় যেমন হয়, জঙ্গলে গুপ্তধনের মতন ! আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, গুড লাক, আর আমি দেখতে পেলাম আগুনশিখার সমুদ্র আর ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে স্বর্গের দিকে ; এবং বাঁদিকে আর ডানদিকে, কোটি-কোটি বজ্রবিদ্যুতের মতন সমস্ত ঐশ্বর্য্য বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছিল।

কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল পানোমত্ততা এবং নারীসঙ্গ ছিল আমার পক্ষে অসম্ভব । এমনকি কোনো বন্ধুসঙ্গও নয় । আমি দেখলাম আমি একদল রাগি মানুষদের সামনে পড়ে গেছি, ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি, তারা যে দুঃখে কাঁদছিল তা তারা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছিল না, আর ক্ষমা করে দিচ্ছিল ! ঠিক যেন জোয়ান অব আর্ক ! -- “যাজকরা, অধ্যাপকরা আর ডাক্তাররা, আপনারা আমাকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে  ভুল করছেন । আমি কখনও আপনাদের একজন ছিলাম না; আমি কখনও নিজধর্মী ছিলাম না ; আমি সেই জাতির মানুষ যারা ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গায়; আমি তোমাদের আইনকানুন বুঝি না ; আমার নৈতিক জ্ঞানগম্যি আছে ; আমি ভালোমন্দজ্ঞানশূন্য ; তোমরা একটা বড়ো ভুল করে ফেলছো…”

হ্যাঁ, তোমাদের ঝলমলে আলোয় আমার চোখ বন্ধ । আমি একটি পশু, একজন কৃষ্ণাঙ্গ । কিন্তু আমার পরিত্রাণ সম্ভব । তোমরা সব নকল কৃষ্ণাঙ্গ ; বাতিকগ্রস্ত, বুনো, কৃপণ, তোমরা সবাই । ব্যবসাদার, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; জজসাহেব, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সেনাপতি, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; সম্রাট, বুড়ো চুলকানো-মাথা, তুমি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ; তুমি শয়তানের হেফাজত থেকে যে মদ খেয়েছো তাতে কেউ কর বসায় না । -- এই দেশকে উৎসাহিত করে জ্বরের তাপ আর কর্কটরোগ । পঙ্গু আর বুড়ো মানুষেরা এতো বেশি শ্রদ্ধার পাত্র যে তারা চায় তাদের উষ্ণতাপে সেদ্ধ করা হোক । -- সবচেয়ে ভালো হবে এই দেশ ছেড়ে বিদায় নেয়া, যেখানে এই হতভাগাগুলোকে প্রতিভূ সরবরাহ করার জন্যে পাগলামি জিনিশটা ঘুরঘুর করে বেড়ায় । আমি প্রবেশ করবো ক্যাম্বোডিয়ার সত্যকার চাম রাজার সন্তানদের দেশে ।

আমি কি প্রকৃতিকে বুঝতে পারি ? আমি কি নিজেকে বুঝতে পারি ? কোনও বাক্য আর আয়ত্বে নেই । আমি মৃত মানুষদের নিজের পাকস্হলিতে পুরে রাখি...হইহট্টোগোল, ঢোলঢোলোক, নাচো, নাচো, নাচো ! আমি সেই মুহূর্তের কথা চিন্তাও করতে পারি না যখন শ্বেতাঙ্গ মানুষরা পোঁছেচে, আর আমি শুন্যতায় তলিয়ে যাবো ।
পিপাসা আর ক্ষুধা, হইহট্টোগোল, নাচো, নাচো নাচো !

-----------------------------

শ্বেতাঙ্গরা তীরে নামছে । কামানের গোলার আওয়াজ ! এখন আমাদের নির্ঘাত ইসলানধর্মে দীক্ষিত করা হবে, পোশাক পরে তৈরি হও, আর কাজে বেরোও ।

আমার হৃৎপিণ্ডকে ঈশ্বরিক করুণায় বিদ্ধ করা হয়েছে । আহ ! আমি কখনও ভাবিনি যে আমার জীবনে এই ঘটনা ঘটবে !

কিন্তু আমি কোনও অন্যায় তো করিনি । আমার দিনগুলো হয়ে উঠবে স্বস্তিময়, এবং পশ্চাত্তাপ থেকে আমাকে মুক্তি দেয়া হবে । যেখানে আনাড়ম্বর আলোকমালা শোকসভার মোমবাতির মতন আরেকবার জ্বলে ওঠে, আমাকে আধমরা আত্মার শুভত্বে পীড়ন করা হবে না । প্রথম সন্তানের অদৃষ্ট, সময়ের আগেই জন্মানো কফিন যা ঝিলমিলে কান্নাফোঁটায় ঢাকা । কোনও সন্দেহ নেই, ন্যায়ভ্রষ্টতা হলো বোকামি, কদভ্যাস হলো বোকামি ; পচনবিকারকে সদাসর্বদা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে । কিন্তু দেয়ালঘড়িকেও শিখতে হবে বিশুদ্ধ যন্ত্রণার সময়নির্দেশের চেয়ে বেশিবার কাঁসরঘণ্টা কেমন করে বাজাতে হয় ! এই সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে, আমাকে কি শিশুর মতন তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, যাতে স্বর্গোদ্যানে গিয়ে খেলা করতে পারি ! তাড়াতাড়ি করো ! সেখানে কি অন্যান্য জীবনও আছে ? -- বৈভবশালীদের পক্ষে শান্তিতে ঘুমোনো অসম্ভব । ঈশ্বর্য্য চিরকাল সবায়ের সামনে খোলামেলা থাকে । কেবল জ্ঞানের চাবিকাঠি দিতে পারে দেবোপম প্রেম। আমি তো দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতি একধরণের দয়ামায়ার প্রদর্শনী । বিদায় বিশপের আঙরাখায় ঢাকা আগুনের নিঃশ্বাস-ওড়ানো দানব, আদর্শবোধ আর ভুলভ্রান্তি । 

উদ্ধারকারী জাহাজ থেকে ভেসে আসছে দেবদূতদের উদ্দেশ্যময় গান : এ হলো দেবোপম ভালোবাসা। -- দুটি ভালোবাসা ! আমি জাগতিক প্রেমে মরে যেতে পারি, আনুগত্যের কারণে মরে যেতে পারি । আমি পেছনে ফেলে যাচ্ছি সেই সমস্ত প্রাণীদের, আমি চলে যাবার পর যাদের যাতনা ক্রমশ বাড়তে থাকবে  ! বাতিলদের মধ্যে থেকে তুমি আমাকে বেছে নিয়েছো, যারা রয়ে গেলো তারা কি আমার বন্ধু নয় ?

তাদের অমঙ্গল থেকে বাঁচাও !

আমি নিমিত্তসিদ্ধির খাতিরে দ্বিতীয়বার জন্মেছি । জগৎসংসার বেশ শুভময় । আমি জীবনকে আশীর্বাদ করবো । আমি আমার ভাইবেরাদরদের ভালোবাসবো ।  বাল্যকালীন প্রতিজ্ঞার ব্যাপার আর নেই। বার্ধক্য আর মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার আশা নেই । ঈশ্বর আমার শক্তি, এবং আমি ঈশ্বরের বন্দনা করি ।

----------------------------
একঘেয়েমি-জনিত বিরক্তিকে আমি আর পছন্দ করি না । দুর্বার-ক্রোধ, বিকৃতকাম, উন্মাদনা, যাদের সব কয়টি স্পন্দনাঘাত আর দুর্বিপাকের সঙ্গে আমি পরিচিত, -- আমার সম্পূর্ণ ভার লাঘব হয়েছে । এবার আমার অপরাধশূন্যতার সীমাকে ঠাণ্ডা মাথায় মূল্যায়ন করা যাক।

প্রহারের সন্তুষ্টি চাইবার মতন অবস্হায় আমি আর নেই ।

আমি আমার নিজের যুক্তিজালে আটক জেলবন্দি নই । আমি তো বলেছি । হে ঈশ্বর । আমি উত্তরণের মাধ্যমে স্বাধীনতা চাই : আমি কেমন করে সেই দিকে যাবো ? ছেলেমানুষির সেই স্বাদ আর নেই । আর দরকার নেই দেবোপম ভালোবাসার কিংবা কর্তব্যের প্রতি উৎসর্জন। আমি ছেলেবেলার আবেগ ও অনুভবের ত্রুটিকে দোষ বলে মনে করিনা । যে যার নিজের যুক্তিপূর্ণতায়, অবজ্ঞায়, সর্বজনপ্রীতিতে রয়েছে : শুভবুদ্ধির দেবদূতোপম সিঁড়ির সবচেয়ে ওপরের ধাপে নিজেকে রেখেছি আমি ।

আর যদি সুস্হিত আনন্দের কথা বলতে হয়, গার্হস্হ হোক বা না হোক...। না, আমি পারবো না। আমি বড়ো বেশি তুচ্ছ, অত্যন্ত দুর্বল । কর্মকাণ্ড জীবনকে কুসুমিত করে তোলে, ওটা পুরোনো ধ্যানধারণা, আমার নয় ; আমার জীবন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নয়, তা কর্মকাণ্ডের থেকে দূরে লক্ষ্যহীন ভেসে চলে যায়, পৃথিবীর সেই তৃতীয় মেরুঅঞ্চলে ।

বুড়ি চাকরানি হয়ে যাচ্ছি আমি, মৃত্যকে ভালোবাসার সাহস হারিয়ে ফেলেছি !

ঈশ্বর যদি আমাকে সেই দিব্যশান্তি দিতেন, নির্মল প্রশান্তি, এবং প্রার্থনা, -- প্রাচীনকালের সন্তদের মতন  -- সেই সন্তরা ! তাঁরা ছিলেন শক্তিমন্ত ! নোঙোর, এমনই এক ধরণের শিল্পী যাঁদের প্রয়োজন আর আমাদের নেই !
এই প্রহসনের কি এবার শেষ হওয়া প্রয়োজন ? আমাকে কাঁদাবার জন্যে আমার শুদ্ধতা যথেষ্ট। জীবন নামের প্রহসনে সবাইকে খেলতে হবে ।

--------------------------

এবার থামাও ! এটা তোমার শাস্তি । -- কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাও !

আহ ! আমার ফুসফুস জ্বলছে, কপাল দপদপ করছে ! রাত্রি ঘনিয়ে আসছে আমার চোখে, এই সূর্যের তলায় ! আমার হৃদয়….আমার দুই হাত আর পাদুটো….

আমরা কোথায় চলেছি ? যুদ্ধ করতে ? আমি বেশ দুর্বল ! অন্যেরা এগিয়ে চলেছে । যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র...আমাকে সময় দাও !

গুলি চালাও ! আমাকে তাক করে গুলি চালাও ! নয়তো আমি তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো নিজেকে । -- ভিতুর দল ! -- আমি নিজেকে খুন করবো ! আমি নিজেকে ঘোড়ার খুরের তলায় নিক্ষেপ করবো !

আহ !

--আমি এ-সবে অভ্যস্ত হয়ে যাবো।

Post a Comment

2 Comments