Header Ads Widget

Responsive Advertisement

হন্তারকের মন লেখা:

 

নাম তার সানোয়ার। ছেনি দিয়ে মানুষ মারে, তাই লোকে বলে ছেইন্না। কেউ নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে সানু। আর লেখার সময় লেখে ছানু। লিখতে কেবল নিজের নামটাই শিখেছে, আর কিছু না। অবশ্য আর কিছু লেখার দরকারও হয় না। পড়ারও না। হাতে নিলেই বুঝতে পারে, কোনটা কয় টাকার নোট। দেখলে যে কেউ বলবে সানু একজন রাখাল বা কৃষক বা জেলে বা মাঝি। আন্দাজটাকে একটু বাড়িয়ে নাচনি বাজারের চা-দোকানদারও ভাবা যেতে পারে। কোনোভাবেই এর বেশি না। সানু এতটাই দীর্ঘদেহী যে তুমুল ভিড়ের মধ্যেও আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়।

সানুকে প্রথম দেখে আমি ট্রাকড্রাইভার ভেবেছিলাম। আমার মাথায়ই ছিল না বিশাল নলুয়ার হাওরের মাঝখানের এই বাজারে ট্রাক তো দূরের কথা, একটা রিকশাও নেই। নৌকাই এখানকার একমাত্র বাহন। আর আছে সাইকেল। তা-ও এখন অকেজো। হাওরে এখন উজানি ঢল, তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট, সাইকেল চালাবে কোথায়? ফাল্গুন-চৈত্র মাসে, সূর্য যখন শুষে নেয় হাওরের সবটুকু জল, সে সময় সাইকেলের দরকার হয়।

তখন সকাল ১০টা। বেশিও হতে পারে। নাচনি বাজার জমে উঠেছে। এদিকের হাটবাজার একটু দেরিতেই জমে। ছোট্ট বাজার। কুড়ি-পঁচিশটি দোকান। মাছবাজারে উঠেছে হাওরের বিচিত্র সব সুস্বাদু মাছ, রাস্তার দুধারে উঠেছে তরিতরকারি। লোকজন কম। বেশি হবে কোত্থেকে? বাজারকে ঘিরে ছোট্ট গ্রাম। বিচ্ছিন্ন দ্বীপ বলা যেতে পারে। এক-দেড় শ র বেশি হবে না জনসংখ্যা। যারা এসেছে, বেশির ভাগই অন্য গ্রামের। হাটবাজার করে ফিরে যাবে। গোটা বাজার ফাঁকা হয়ে যাবে দুপুরে। আবার জমবে বিকেলে।

ঘুরে ঘুরে আমরা মাছ দেখছিলাম আর বাজারের লোকজন দেখছিল আমাদের। সবার চোখেমুখে কৌতূহল। দেখে যে কেউ বুঝতে পারছে আমরা যে বহিরাগত। আমাদের পরনে শর্টস, পায়ে কেডস, চোখে চশমা। এই বাজারে চশমাওয়ালা দু-একজন বুড়ো খুঁজে পাওয়া গেলেও কেডস-শর্টস পরা কাউকে পাওয়া যায় না। সবার পরনে মলিন লুঙ্গি, টুটাফাটা শার্ট কিংবা চিতেপড়া গেঞ্জি।

যে লোকটি আমাদের এতক্ষণ শিকারির মতো চোখে চোখে রাখছিল, হঠাৎ সে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আপনেরা?

আপনি? আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

আমি? হা হা...আমারে কি আপনেরা চিনবেন? আমি সানু।

একটু থমকে গেলাম। বলা যেতে পারে ভড়কে গেলাম। গত রাতে সানুর কথা শুনেছি। গতবার জলমহাল নিয়ে হাঙ্গামার সময় ছেনির এক কোপে সানু কীভাবে একজনের কল্লা ফেলে দিয়েছিল, তার আগেরবার কীভাবে আরেকজনের ভুঁড়ি নামিয়ে দিয়েছিল, তারও আগে কেমন করে চিলাউড়ার ফারুক মেম্বারের ডান হাতটা উড়িয়ে দিয়েছিল—এসব গল্প আমাদের বলেছিল রাজীব। শুনতে শুনতে ভয়ে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছিল। কল্পনায় আমি এঁকে নিয়েছিলাম সানুর একটা অবয়ব। ইয়া লম্বা গোঁফ, ঘাড় অবধি চুল, টকটকে লাল চোখ। অথচ কল্পনার সানুর সঙ্গে বাস্তবের সানুর কোনো মিল নেই। মুখে খোঁচা দাড়ি, খাদে পড়া চোখ, নিচে কালো দাগ, কোনায় অগুনতি ভাঁজ, মাথায় টাক, পরনে নীল লুঙ্গি আর হলুদ গেঞ্জি। এ কি সেই সানু? আমার মনে ভয় জাগল। উল্টাপাল্টা কিছু বললে সানু না আবার খেপে যায়! ডাঙায় চরে বেড়ানো সাপকে লাঠির এক আঘাতে খতম করে দেওয়া যায়, গর্তের সাপকে নয়। গর্তের সাপ বড় ভয়ংকর। হাত ঢোকালেই ছোবল মারে। লাঠি ঢুকিয়েও কাবু করা যায় না। সভ্যতার ছোঁয়া না-লাগা এই নাচনি বাজারকে যদি একটা গর্ত ধরি, সানু তবে সেই গর্তের ভয়ংকর গোখরো। তার নিশ্বাসে হলাহল, সহস্র তার বিষদাঁত। তাকে জমাখরচ দিয়ে চলতে হয়, তার সঙ্গে হুঁশিয়ারে কথাবার্তা বলতে হয়।


হেসে বললাম, আমরা আপনাদের মেহমান। বেড়াতে এসেছি।

কার বাড়িতো আইছেন?

বেতাউকা চৌধুরী বাড়ির কথা বললাম। সানু একটু গলে গেল। শুকনো ঠোঁটটা টেনে খানিক হাসি ফুটিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, মেহমান মানুষ, চা-পানি কিছু খাইছেন নি কিতা?

আপনি খাওয়ালে খেতে রাজি আছি।

কিতা যে কন ভাইসাব! গরিব হইতাম পারি, তাই বলিয়া কইলজা কিতা গরিব নি? এই কইলজার ভিত্রে গোটা নুল্লার হাওর হারাই দেওন যাইব। চলেন, দোকানো চলেন।

কাছেই বাঁশের মাচানের ওপর ‘মায়ের দোয়া’ হোটেল। অর্ধেক জলে, অর্ধেক স্থলে। সানু আমাদের নিয়ে গেল সেই হোটেলে। গুলগুলা, শিঙাড়া আর সমুচা ভাজা হচ্ছে।

কী খাইবেন আপনেরা? জিজ্ঞেস করল সানু। আমি বহুদিন গুলগুলা খাইনি। শেষ কবে খেয়েছি, মনে নেই। তাই গুলগুলা দিতে বললাম। প্লেট ভরে দিয়ে গেল দোকানি। আমরা খেতে শুরু করি। সানু পায়ের ওপর পা তুলে বিড়ি ধরায়। সে খাবে না। আলুভর্তা দিয়ে বাড়ি থেকে পান্তা খেয়ে এসেছে, খিদে নেই। খেতে খেতে আমরা সানুর কথা শুনি। হাওরের মাছের গল্প করে সানু। মাছের সিজন তো এখনো শুরু হয়নি। সবে তো বর্ষা এল। শ্রাবণ যাবে, ভাদ্র যাবে। তারপর আসবে আশ্বিন। তখন শুরু হবে মাছের আসল সিজন। সব মাছ চলে যায় শহর-বন্দরে। এদিকের মানুষ মাছ খায় না। কত খাবে? খেতে খেতে বিরক্ত।


আপনার বাড়ি কি এদিকে কোথাও? আমি জিজ্ঞেস করি।

এই তো কান্দাতেই। পাঁচ মিনিটোর পথ।

কী করেন?

কী আর করমু, হাত নাড়িয়া-চাড়িয়া খাই।

হাত নেড়েচেড়ে তো সবাই খায়। কোন কাজে হাত লাগে না? চাষবাদে লাগে, নৌকা বাইতে লাগে, গাড়ি চালাতে লাগে। হাত ছাড়া কিছু হয়? আপনি কী নাড়াচাড়া করেন, সেটা জানতে চাইছি।

মাইনষের জীবন নাড়াচাড়া করি, ভাই। অট্টহাসি দিল সানু।

ইন্টারেস্টিং! যদি একটু খুলে বলতেন...।

এবার ধীরে ধীরে নিজেকে খুলতে থাকে সানু। বছরে দশ মাস বলা যায় সে বেকারই থাকে। খায়-দায়, ঘোরে-ফেরে, হাটে–বাজারে আড্ডা মারে আর সংসারের টুকটাক কাজকর্ম করে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে, হাওরের জলে যখন টান শুরু হয়, ধীরে ধীরে যখন জাগতে থাকে ডাঙা, তখন শুরু হয় জলমহাল দখলের তোড়জোড়। সানুর ডাক আসে উত্তর থেকে, দক্ষিণ থেকে, পূর্ব থেকে, পশ্চিম থেকে। আজ চিলাউড়া তো কাল কামারখাল, পরশু জারলিয়া তো তরশু জগদল। যে যত বেশি টাকা দেবে, সানু সাড়া দেবে তার ডাকে। প্রতি খুন পঞ্চাশ হাজার। কেবল টাকা দিলে হবে না, থানা–পুলিশ আর কেস-মামলাও সামাল দিতে হবে। গত চুয়াল্লিশ বছরে সানু ষাট-সত্তরটা খুন করেছে। বেশিও হতে পারে। হিসাব রাখেনি। কতবার জেল খেটেছে, তারও কোনো হিসাব নেই। এখন আর খাটতে হয় না। পুলিশ বিরক্ত। তাকে ধরতে আসে না। কত আর আসা যায়! সেই কোথায় থানা! এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে রোজ রোজ তাকে খুঁজতে আসবে, পুলিশের কি আর কাজ নেই?শুরুর দিকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা খুনখারাবি করলে সানুর খারাপ লাগত, এখন আর লাগে না। প্রথমবার, তার বয়স যখন ষোলো, তাদের জলমহাল নিয়ে হাঙ্গামার সময় কামারখালের লাতু মেম্বারের গলায় ছেনি চালানোর পর তার খুব খারাপ লেগেছিল। রক্তে ভিজে গিয়েছিল দুই হাত। সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধোয়ার পরও যাচ্ছিল না রক্তের দাগ। যেন আজীবন যাবে না, লেগে থাকবে জন্মদাগের মতো। সে ভাত খেতে পারত না। খেতে বসলে মনে হতো মানুষের মাংস খাচ্ছে। ঘুমাতে পারত না। চোখ বুজলেই অন্ধকারে ভেসে উঠত লাতু মেম্বারের কাটা মুন্ডু। খাওয়াহীন, ঘুমহীন থাকতে থাকতে সানুর মনে হতো সে পাগল হয়ে যাবে। পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরতে হবে। সদরের ডাক্তার দেখিয়েছিল। কিছু ওষুধ দিয়েছিল ডাক্তার। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল সে। কিন্তু পরের বছর বেতাউকা ভূঞাবাড়ির জলমহাল নিয়ে হাঙ্গামার সময় বুরাখালির ধনা মিয়ার ভুঁড়ি নামিয়ে দিতে হলো তাকে। নামানোর ইচ্ছা ছিল না। ধনাকে সে বলেছিল, ‘চলিয়া যা বাপ, ভেজাল করিস না। এই মহাল ভূঞাদের। তুই মাথা হান্দাইস না।’ কথা শুনল না ধনা। উল্টো বলে বসল, ‘তোর বাপর কল্লা যেমুন করিয়া নামাইছিলাম, তোর কল্লাও তেমুন করিয়া নামাইমু হালার ফুয়া।’ কথা শেষ করার আগেই তার পেটে সানু ঢুকিয়ে দিল টেঁটা। সানু ভেবেছিল তার পুরোনো রোগটা আবার চাড়া দেবে। আবার সে খেতে পারবে না, ঘুমাতে পারবে না। অথচ কিছুই হলো না। মনে হলো না সে কোনো মানুষ খুন করেছে, যেন মানুষের রক্তখেকো একটা মশা মেরেছে।

দ্বিতীয়বার জেল থেকে ফেরার পর খুনখারাবি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল সানু। দরগায় গিয়ে তওবা করেছিল জীবনে আর হাতে ছেনি তুলবে না, টেঁটা তুলবে না। কিন্তু তার তকদির খারাপ, খুনখারাবি তাকে ছাড়ল না। তালুকদারবাড়ির জলমহাল নিয়ে গন্ডগোলের সময় তার চাচাতো ভাই মনোয়ারকে খুন করল মনির মোল্লার লোকেরা। সানু কি আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? সে খোদ মনির মোল্লার কল্লাটাই ফেলে দিল। তারপর আর কখনো খুনখারাবি ছাড়ার কথা ভাবেনি। কেন ভাববে? খুনখারাবি ছেড়ে লাভটা কী? সে ছেড়ে দিলে কি এই হাওর-বাঁওড়ের দেশে খুনখারাবি বন্ধ হবে? হবে না। ছেনি সে না তুললে আরেকজন তুলবে। টেঁটা সে না ধরলে আরেকজন ধরবে। খুন সে না করলে আরেকজন করবে। এ খুনোখুনি থামার নয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, যুগ যুগ ধরে চলবে। যত দিন হাওর থাকবে, জল থাকবে, জলমহাল থাকবে, তত দিন এই খুনোখুনি চলতেই থাকবে। কেউ থামাতে পারবে না।

বারবার ফোন দিচ্ছিল রাজীব। নাশতা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, এখুনি ফিরতে হবে। নৌকা অপেক্ষা করছে ঘাটে। সানুর সঙ্গে একটা সেলফি তুলতে চাইলাম। চট করে সরে বসল সানু। হাত তুলে বলল, না না, আপনেরা ভালা মানুষ। ছবিতে আমার সাথে দেখিলে লোকে আপনাদের খারাপ কইব। সানু আমাদের উজিয়ে দিতে ঘাটে এল। যখন নৌকায় উঠতে যাব, তখন ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল সানু। হ্যান্ডশেক করলাম। আমাকে জড়িয়ে ধরে সানু বলল, মনে কিছু নিয়েন না ভাইজান, মেহমানদারি কিছু করতাম পারছি না। আপনের সাথে মাতিয়া মনো শান্তি পাইছি। আবার কখনো আইলে আমার বাড়িতো একবেলা খাইলে খুব খুশি হইমু।

নিশ্চয়ই সানু ভাই। আরেক দিন বেড়াতে আসব। আমি বললাম।

নৌকা ছেড়ে দিল। হাত নাড়াচ্ছে সানু। আমি তার মুখের দিকে তাকাই। স্পষ্ট দেখতে পাই, বাতাসলাগা পাতার মতো তির তির করে সানুর ঠোঁট কাঁপছে, থুতনি কাঁপছে। সহসা দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। শিশুর মতো দুহাতে চোখ মুছল সানু।

স্বকৃত নোমান

Post a Comment

0 Comments